বন্ধু’৯৮

বন্ধু'৯৮ (ব্যাচ ৯৮)

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার সাল হিসেব করেই বগুড়া জিলা স্কুলের স্নাতক ব্যাচ ধরা হয়। সে হিসেবে বন্ধু'৯৮ এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৯০ সালে, অর্থ্যাত ১৯৯০ সালে আমরা তৃতীয় শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। খুব সম্ভবত 'বন্ধু ৯৮' এর ক্লাস শুরু হয়েছিলো ১৯৯০ সালের জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে। আমাদের ভর্তির সময়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব আব্দুল মজিদ স্যার। কিন্তু আমাদের ক্লাস শুরুর অব্যবহিত পরেই স্যার রিটায়ার করেন।  আগেই উল্লেখ করেছি ঐতিহ্যগত কারনে বাবা-মা দের তুমুল প্রচেষ্ঠা থাকে তাদের ছেলেকে বগুড়া জিলা স্কুলে পড়ানোর জন্যে। আর এজন্যে দেখা যায় ৪০০-৫০০ জন ভর্তি পরীক্ষা দিলেও, আমাদের ('বন্ধু ৯৮') সময়ে ভর্তির জন্যে উত্তীর্ন হয়েছিলো ১২০ জনের মতো। এই উত্তীর্ন ছাত্রদের দুইটি সেকশানে ভাগ করে ( A, B) ভর্তির ক্রমানুসারে ক্রমিক নং এর ভিত্তিতে শুরু হয় আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করার যাত্রা। আমরা প্রথমে প্রভাতি (মর্নিং শিফট) শাখায় ক্লাস শুরু করি; আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাবা সুফিয়া খাতুন ম্যাডাম এবং শ্রেনী শিক্ষক ছিলেন যথাক্রমে  আজমল স্যার ও তানজিমা ম্যাডাম। স্কুল থেকে স্নাতক হবার ২৫ বছর পরে স্বাভাবিকভাবেই ৮ বছরের সেই যাত্রার স্মৃতিগুলো অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে, তারপরেও দ্বিধাহীন এবং দ্ব্যার্থহীন ভাবে বলা যায়, আমাদের বর্তমানের যা উদ্যম, অর্জন বা ভবিষ্যতের জন্যে যা পূজি করা হয়েছে তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী পাঠ আমরা পেয়েছি সেই ৮ বছরে। এই ৮ বছরে বাড়ির গন্ডির বাহিরে এসে যেমন আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শাসনের আওতায় চলে এসেছিলাম, তেমনি পেয়েছিলাম ‘বন্ধু’ নামের একটা সম্পর্ক গড়ার সুযোগ যা অত্যাবধি আমাদের জীবনে বহমান। এই সময়টাতে আমরা পেয়েছি অনেক গুনী শিক্ষকের সংস্পর্শ তেমনি পেয়েছি কিছু কঠোর শিক্ষকের বেতের নিদারুন মার। ঐ সময়টাতে মার বা শাসনের ব্যাপারগুলো কদর্য লাগলেও এখন এসে আমরা অনুভব করে সম্মানিত সেই শিক্ষকগণের স্নেহময় শাসনই ছিলো আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম অস্ত্র।

এই সময়কালেই আত্মস্থ করেছিলাম স্কুলের গন্ডিতে প্রথম পা দেবার পর পড়া বাক্য দুইটার মানে কি?

‘শিক্ষার উদ্দেশ্যে আসো

সেবার জন্যে বেরিয়ে যাও’

কেমন ছিলো আমাদের দৈনন্দিন স্কুল জীবনঃ

এসেম্বলীঃ

প্রতিদিন স্কুলে আসার পর প্রথম কাজ হতো স্কুলে পছন্দমতো সীটে ব্যাগটা রাখা। এরপরেই স্কুল শুরুর ঘন্টা পড়তো। কয়েকজন দপ্তরী এইসময়ে পালাক্রমে এই ঘন্টা দেবার কাজ করতেন। তবে তৃতীয় শ্রেনীতে যতদূর মনে পড়ে ঘন্টা দেবার কাজ করতেন আব্দুর রহমান চাচা, পর্যায়ক্রমে এই কাজ করেছেন বাসুদেব ভাই, বাকী ভাই, ফয়েজ চাচা প্রমূখ। ঘন্টা পড়ার পরপরই আমরা এসেম্বলীর লাইনে দাঁড়িয়ে যেতাম। প্রতিটা শ্রেনীর জন্যে লাইনের জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিলো। এসেম্বলীর সময়ে তিনটা আনুষ্ঠিকতা পালন করা হতো সবসময়। সুরা ফাতিহা পাঠ, এরপর শপথ পাঠ এবং সবশেষে মিলিত কন্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া। সাধারণত প্রথম দুইটা আনুষ্ঠিকতার জন্যে একেক দিন একেক শ্রেনী থেকে ডাকা হতো দুইজনকে। 'বন্ধু ৯৮' এর দিবা শাখায় সুরা ফাতিহা সাধারণত পড়তো রাশেদুল ইসলাম রনি অথবা ফয়সাল কবীর শুভ। আর শপথ পাঠ করতো মাহবুব উদ্দিন প্যাটেল। এসেম্বলীতে সব শিক্ষকগণই এসে দাড়াতেন। এইসময় প্রধান শিক্ষকের কোন বার্তা দেবার থাকলে দিতেন, কাউকে সবার সামনে শাস্তি দেবার থাকলে বেত দিয়ে মারতেন অথবা নিল ডাউন করে রাখতেন। যেহেতু সকল ছাত্রদের এসেম্বলীতে আসা বাধ্যতামূলক ছিলো, দিবা শাখার এসেম্বলীর সময় প্রায় দেখা যেতো কেউ না কেউ লাইনে অসুস্থ হয়ে পড়ে যেতো বিশেষ করে যেদিন রোদ খুব চড়া থাকতো।

টিফিনঃ

স্কুলের প্রথম তিন পিরিয়ড শেষে আমাদের স্কুল থেকেই টিফিন দেওয়া হতো। প্রথম পিরিয়ড শেষে একজন দপ্তরী এসে ক্লাসের উপস্থিত ছাত্রের সংখ্যা লিখে নিয়ে যেতেন। তৃতীয় পিরিয়ডের ঘন্টা দেবার কিছু আগে ক্লাস ক্যাপ্টেন গিয়ে টিফিন নিয়ে আসতো। গোবিন্দ স্যার টিফিন বানানোর ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রন করতেন।

বিভিন্ন সাময়িকী পরীক্ষাঃ

আমাদের সময়ে বছরে তিনটা পরীক্ষা হতো- প্রথম সাময়িকী, দ্বিতীয় সাময়িকী এবং বার্ষিক পরীক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঠিক করা হতো তিন পরীক্ষার গড় দিয়ে। সাধারণত এপ্রিল/মে মাসে হতো প্রথম সাময়িকী পরীক্ষা, অগাস্টে হতো দ্বিতীয় সাময়িকী এবং নভেম্বর/ডিসেম্বরে হতো বার্ষিক পরীক্ষা। বাংলাদেশে অন্য সব স্কুলের মতো বগুড়া জিলা স্কুলেও বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হতো নভেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে।

বার্ষিক ছুটিঃ

স্কুলে ভর্তি হবার পরে প্রথম বার্ষিক পরীক্ষা দেবার পর স্কুল প্রায় একমাস ছুটি পেলাম। এখনকার মতো তখন আমাদের হাতে কোন ডিজিটাল গেজেট ছিলোনা, তাই ছুটি পেলেই আমরা দাদা/নানা বাড়ি বেড়াতে যেতাম। এইসময়টা যেহেতু বাংলাদেশে শীতকাল হয়ে থাকে, গ্রামের বাড়িতে গেলে অনেক ধরনের পিঠা-পুলি, খেজুরের রস এসব খাওয়া যেতো। শীতকালীন রবিশস্য লাগানো হতো ক্ষেতে-খামারে। সবমিলিয়ে ডিসেম্বর মাসের গ্রামের পরিবেশটা খুব মোহময় থাকতো। তাই আমাদের কাছে বছরের শেষটা ছিলো সবচেয়ে আকাংক্ষিত সময়। যত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আসতে থাকে, বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে একদিকে শুরু হতো উৎকন্ঠা আবার অন্যদিকে নতুন ক্লাসে নতুন বই পাবার জন্যে এক ধরনের উত্তেজনা। 'বন্ধু ৯৮' যখন বগুড়া জিলা স্কুলে পড়তাম তখন মার্চ/এপ্রিল মাসের দিকে স্কুলে এস এস সি পরীক্ষার আসন বিন্যাস হতো বলে আমরা আরেকটা এক মাসের ছুটি পেতাম। যখন প্রাথমিক শ্রেনীর ছাত্র ছিলাম, তখন এই ছুটির সময় বেশিরভাগ কাটতো খেলাধুলা এবং পাড়া-মহল্লায় ঘোরাঘুরি করে।

ঘটনা বহুল ১৯৯০-৯৮ঃ

আমাদের 'বন্ধু ৯৮' এর ১৯৯০-৯৮ জিলা স্কুল সময়কালে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবনে বেশকিছু স্মরনীয় ঘটনা ঘটেছিলো যার কিছুটা প্রভাব পড়েছিলো আমাদের স্কুল জীবনেও। উল্লেখযোগ্য কিছু হলোঃ

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল
১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী সরকারের পতন
১৯৯১ সালে দুই সেকশান থেকে চারটি সেকশান এবং ডে-মর্নিং শিফট ভাগ
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ
১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রথম বোঝা
১৯৯৩ সালে বাধ্যতামূলক আরবী ভাষার ক্লাসে বিপর্যয়, হুমায়ুন আহমেদের আগমন

১৯৯৮ সালে নতুন সিলেবাসে এস এস সি পরীক্ষা

সাল ১৯৯০ঃ

জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বাবা-মা’র বহু আরাধ্যের সেই জিলা স্কুলে শুরু হলো স্বপ্নের যাত্রা। অনেকটা মাতৃক্রোড়ের বাহিরে এসে শুরু হলো সকাল ৬ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত একটা দীর্ঘসময় স্কুলের নিয়ম-নীতির মধ্যে আবদ্ধ থাকার অভ্যাস প্রক্রিয়া। আমাদের যারা সেকশান A পেয়েছিলাম তাদের শ্রেনী শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় আজমল স্যার, যিনি ইংরেজী পড়াতেন। অন্যদিকে সেকশান B তে শ্রেনীশিক্ষিকা ছিলেন শ্রদ্ধেয়া তানজিমা ম্যাডাম। আজমল স্যার ছিলেন যতটা শান্ত আচরণের ঠিক তার বিপরীত স্বভাবের ছিলেন তানজিমা ম্যাডাম। আজমল স্যারের জনপ্রিয় ডায়লোগ ছিলো- 'কি গো তোমরা কথা কচ্চোনা যে'। আর তানজিমা ম্যাডামের প্রিয় বাক্য ছিলো বোধহয় 'ঐ একেবারে গলা ছিড়ে ফেলমু'। যাইহোক, মরহুম হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন গল্পে যেখানে বগুড়া জিলা স্কুলের উল্লেখ আছে, সেখানেও স্কুলের কিছু শিক্ষকদের বদরাগী হিসেবে দেখিয়েছেন। উনাদের সময়ে কঠোর শাসন যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো তা আমাদের সময়ও বজায় ছিলো বেশটাই।

যাইহোক, স্কুলের প্রথম তিন পিরিয়ড শেষে আমাদের স্কুল থেকেই টিফিন দেওয়া হতো। প্রথম পিরিয়ড শেষে একজন দপ্তরী এসে ক্লাসের উপস্থিত ছাত্রের সংখ্যা লিখে নিয়ে যেতেন। তৃতীয় পিরিয়ডের ঘন্টা দেবার কিছু আগে ক্লাস ক্যাপ্টেন গিয়ে টিফিন নিয়ে আসতো। গোবিন্দ স্যার টিফিন বানানোর ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রন করতেন।

এই সালে্র মাঝামাঝি ইতালীতে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়া আমাদের জন্যে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং দলগুলোর সাথে প্রথম পরিচিত হবার সুযোগ হলো। সেইসময়ে মফস্বল এলাকার বেশিরভাগ যাদের বাসায় টেলিভিশন ছিলো, সেইগুলো ছিলো সাদা কালো এবং সাইজে ২২ ইঞ্চির বেশি না। আর বিশ্বকাপ ফলাফল দেখার জন্যে তাকিয়ে থাকতে হতো খবরের কাগজের দিকে। সেইসময় জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো বগুড়ায় পাওয়া যেতো বিকেলের দিকে। বিশ্বকাপের উত্তেজনা আমাদের কিশোর মনেও ছুয়ে গিয়েছিলো বেশটাই।

সাল ১৯৯১ঃ

১৯৯১ সালের জানুয়ারী মাসের ১ তারিখেই আমরা নতুন ক্লাসের জন্যে স্কুলে যেতাম। বছরের প্রথম মাসটা তেমন একটা ক্লাস হতো না কারন নতুন বই হাতে আসতে আসতে আরো সময় লাগতো। তাই জানুয়ারী মাসটা মোটামুটি আমরা প্রথম/দ্বিতীয় পিরিয়ডের পরে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করতাম। ১৯৯১ সালে আমরা চতুর্থ শ্রেনীতে উঠার পর কয়েকটা আকস্মিক পরিবর্তন ঘটলো।

পরিবর্তন ১ঃ প্রতিটা শ্রেনীকে রোল নাম্বারের উপর ভিত্তি করে দুইটি থেকে চারটি সেকশানে ভাগ করা হলো। সেকশান এ এবং সেকশান বি কে রাখা হলো প্রভাতী শাখায়, আর সেকশান সি আর ডি কে দেয়া হলো দিবা শাখায়। অর্থ্যাত অনেকটা সম্পত্তি ভাগের মতো, ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে দুইভাগ করে দেয়া হলো যার মাধ্যম দশম শ্রেনী পর্যন্ত আর একইসময়ে স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে থাকার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেলো।

পরিবর্তন ২ঃ এইসময়ে স্কুলে বেশ কিছু সংখ্যক নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলো। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক তরুন শিক্ষকেরা স্কুলে যোগ দেয়ায় মনে হলো শিক্ষকগণ ছাত্রদের শাসনের জন্যে বেতের উপর নির্ভরতা কমাবে এখন । কিন্তু যতটা আশা করা হয়েছিলো ততটা পূরন হলোনা।